শুধুই তিন বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত স্থায়ী ক্যাম্পাস দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করা উচিত নয়। পড়াশোনার মান কেমন সেটা দেখা উচিত। কেননা, তিন বিঘার চেয়ে এক বিঘায়ও বহুতল ভবন করে অনেক বেশি জায়গা তৈরি করা যায়। এখন জমির যে দাম এবং দুষ্প্রাপ্যতা বিদ্যমান, অখণ্ড এক একর বা তিন বিঘা জমি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর ঢাকা কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিন্তা করলে তো হবে না। অন্যদিকে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে। কারণ, আজকাল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বমানের স্নাতক ডিগ্রিধারী বেরোচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী গত সোমবার তাঁর নিজ দপ্তরে বসে বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী বলেন, 'শিক্ষার গুণগত মান এবং উৎকর্ষ সাধনই এক নম্বর প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। কেউ হয়তো বলতে পারেন, শিক্ষার বিস্তৃতিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে, বিস্তৃতিটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু একমুখী না। কারণ কিছু ভালো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যারা আন্তর্জাতিকমানের স্নাতক ডিগ্রিধারী তৈরি করছে। এর সংখ্যা এত কম যে, জাতির প্রয়োজন মেটাতে পারছে না।'
ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, 'কেউ কেউ মনে করেন, ক্যাম্পাস অত্যাবশ্যক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে ক্যাম্পাসকে আলাদা করে দেখা যায় না। ক্যাম্পাস না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি অনেকাংশে একমত। তবে আমার কিছু ভিন্ন দৃষ্টি আছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা তো জ্ঞানের বিস্তার, প্রসার, চর্চা ও লালন এবং জ্ঞান সৃষ্টির জায়গা। সেখানে অবকাঠামোর বিষয়টি সেকেন্ডারি পর্যায়। প্রাইমারি হলো, মানসম্পন্ন শিক্ষক, গবেষণার সুযোগ, শিক্ষার্থীদের গুণগত মান, একাডেমিক কারিকুলাম কোন মানের সে বিষয়টি। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এগুলোর প্রত্যেকটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ।'
১৫ হাজার শিক্ষার্থী আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে বিস্তৃত ক্যাম্পাস দরকার, দুই বা তিন হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই পরিমাণ জায়গা নিয়ে ক্যাম্পাস নির্মাণের দরকার হবে কেন_এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, 'অখণ্ড এক একর জমির ওপর ক্যাম্পাস নির্মাণ নিয়ে সরকারের একটি ঘোষিত নীতি আছে। এ বিষয়ে আমার দ্বিমত নেই। তবে আমি বলব, ক্যাম্পাসের পাশাপাশি মানসম্পন্ন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, লাইব্রেরি, কারিকুলাম সবই থাকবে। শুধুই তিন বিঘা জমির ওপর নির্মিত ক্যাম্পাস দিয়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করার ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয়। আমি মনে করি, যদি একটি বা কয়েকটি বহুতল ভবনে যথেষ্ট জায়গা থাকে অথবা দীর্ঘমেয়াদি লিজেও যদি তা পাওয়া যায় তাহলে সেটা বিবেচনা করা যেতে পারে।'
অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, 'যদি জায়গার অনুপাতে বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তাহলে সেটা কিন্তু তিন বিঘায়ও হবে না। যখন পুরোপুরিভাবে ক্যাম্পাস করার জন্য, ক্যাম্পাস লাইফ, একাডেমিক, এঙ্ট্রা একাডেমিক অ্যাকটিভিটি, খেলাধুলা, গান-বাজনার চর্চা, ডরমেটরি_এগুলোর কথা যদি চিন্তা করি তাহলে তিন বিঘা কেন, আরো বেশি দরকার হবে। তবে সেটা ঢাকা শহরে করা যাবে কি না আমার সন্দেহ আছে। কারণ এখন জমির যে দাম এবং দুষ্প্রাপ্যতা বিদ্যমান, সে হিসেবে অখণ্ড তিন বিঘা জমি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা করলে তো হবে না।'
অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, প্রায় দুই কোটি মানুষ ঢাকায় বসবাস করে। এখানে তিন বিঘার ওপরে ক্যাম্পাস তৈরির চিন্তা করাটা মনে হয় ঠিক হবে না। ঢাকার আশপাশে যেমন আশুলিয়া, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কের পাশে বড় ও আদর্শ ক্যাম্পাস হতে পারে। তবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে ভার্চুয়াল ইউনিভার্সিটির কথা যেখানে সারা বিশ্ব চিন্তা করে সেখানে ফ্রেম বেঁধে দিয়ে ক্যাম্পাস স্থাপনের চাপ প্রয়োগ করা বোধহয় ঠিক নয়। তবে এটাও ঠিক, যত্রতত্র বা যেখানে-সেখানে কয়েকটা রুম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা গ্রহণযোগ্য নয়। এ দুটোর সমন্বয় করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। আর উন্নয়নের একটা পর্যায়ে এ রকমই হয়। চীনে যখন উন্নয়নকাজ শুরু হলো, তারা বাণিজ্যিক এলাকা দূরের কথা, আবাসিক এলাকায়ও ছোট ছোট শিল্পকারখানা গড়তে শুরু করল। এতে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৯/১০-এ উঠে গেল। এখন তারা বড় বড় বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করে বড় বড় শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছে।
আজাদ চৌধুরী বলেন, স্থায়ীভাবে ভাড়া বাড়িতে যদি ক্যাম্পাস থাকে, তাহলে সেটার নজরদারি কে করবে, কত দিন চলবে_এ রকম প্রশ্ন আসতে পারে। দেখা গেল, ব্যবসা ভালো হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ও চলল, কিন্তু খারাপ হলে বিক্রি করে দিল, সেটা তো জাতির জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হলো না? তাই এ দুইয়ের সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন।
প্রাথমিক অবস্থায় যারা শুরু করেছে বা করছে তাদেরকে একটা যথাযথ সময় দিয়ে চাপ দেওয়া যে, তোমরা নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাও। তবে যতক্ষণ যেতে পারছে না ততক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সে জন্য একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, 'এসব বিষয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ইউজিসি সদস্যদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসব। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, যে হারে আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রী ভালো ফল করে বেরোচ্ছে, ভবিষ্যতে তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সেটা বেসরকারি বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক না কেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এখন লাঙ্ারি নয়, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে, মানবমুক্তির জন্য উন্নতমানের স্নাতক ডিগ্রিধারী তৈরি করা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়।'
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, 'গুণগতমান অবশ্যই আছে, কিন্তু সমাজ ও বিশ্ব যেটা দাবি করে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রিধারীরা তার ধারে-কাছেও নেই। এর জন্য অনেক কিছুই দায়ী, অর্থনৈতিক সমস্যা, পরিকল্পনায় সমস্যা, শিক্ষা এবং কমিটমেন্টের সমস্যা_সেটা আমার, শিক্ষকদেরও রয়েছে। একই সঙ্গে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটাই এমন যে উত্তরণের জন্য সময় ও সুযোগ যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় না।'
অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে আমার কিছু পরিকল্পনা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরে কোনো চাপ বা নির্দেশ নয়, ইউজিসি সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। শুধু এক জায়গায় ইউজিসি নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষার গুণগত মানের সঙ্গে আপস করবে না। সেটা সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যা-ই হোক না কেন।'
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আজাদ চৌধুরী বলেন, 'আপনারা অনেকেই ভালো ভালো অবস্থানে আছেন, মূলধন বাড়িয়েছেন। ফ্যাকাল্টি উন্নয়নের জন্য কিছু করুন। কারণ যেখানে ৫০-১০০ কোটি টাকা লাভ হয়, সেখানে পিএইচডির জন্য তিন-চারটি স্কলারশিপ কিছুই নয়।'
অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী বলেন, ২০২০ সালে বিশ্বের অর্ধেক স্নাতক ডিগ্রিধারী বের হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগ ইউনেস্কো থেকেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। ইউনেস্কো বলে, শিক্ষা বিনিয়োগের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র। তারা এমনও বলে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে লাভ করতে দাও, তবুও তারা যেন উচ্চ শিক্ষা দেয়। তিনি বলেন, 'তবে তার অর্থ এই নয় যে, ঢালাওভাবে ব্যবসা করে খালি সার্টিফিকেট বিক্রি করব। সেটা হলে জাতির ও শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার করা হবে। একই সঙ্গে আমাদের অগ্রগতি ব্যাহত হবে।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন